অনলাইনে আর্থিক প্রতারণায় কোটি টাকা হারালেন এক তরুণ, কীভাবে বাঁচবেন এসব ফাঁদ থেকে

 

 

প্রতারকেরা ধাপে ধাপে আস্থা অর্জন করে। এমনভাবে ফাঁদ সাজায় যে তাতে পা দিয়ে ফেলেন অনেকেই। ওয়েবসাইট, ট্র্যাকিং নম্বর, অনলাইন লোকেশন, হেল্পলাইন—এসব তৈরিই থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বিশ্বাস করে। প্রতারকেরা সব সময় জরুরি অবস্থার সৃষ্টি করে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বলে। লোভের বশবর্তী হয়ে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। টাকা বিনিয়োগ করার আগে সময় নিন।অনলাইনে সম্পর্ক গড়ে টাকা খোয়ানো বা অ্যাপে বিনিয়োগ করে প্রতারণার শিকার হওয়ার ঘটনা এখন যেন নিত্যদিনের ব্যাপার হয়ে উঠছে। হোয়াটসঅ্যাপে বন্ধুত্ব করে টাকা খোয়ানো, ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামে প্রেমের ফাঁদে ফেলে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া, মাল্টিলেভেল মার্কেটিং বা এমএলএম ব্যবসার প্রতারণা—এসবের পর সম্প্রতি দেখা গেল, এমটিএফইর মতো অ্যাপভিত্তিক ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার প্রতারণা। মোড়ক নতুন, প্রতারণার কৌশল ঘুরেফিরে সেই এক। ডেসটিনি, ইউনিপেটুইউ, যুবক, ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, এমটিএফই—নানা ধরনের স্ক্যাম বা প্রতারণার তালিকা কেবলই দীর্ঘ হচ্ছে। এত সংবাদ, সতর্কবাণীর পরও কেন একই ফাঁদে বারবার পা দেয় মানুষ?

 

ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাতেন ঢাকা কলেজের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী আবু তালহা। গত বছরের অক্টোবরে তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে একটি লিংক আসে। সেই লিংকে ঢুকে একটি বিজ্ঞাপন দেখতে পান তিনি। চটকদার সেই বিজ্ঞাপনে বলা ছিল, ‘বরগাটা’ নামের একটি অ্যাপ নামিয়ে সেখানে ১০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করে দৈনিক ৮০০ থেকে ৫ হাজার টাকা আয় করুন।’ বিজ্ঞাপনটি দেখে ধাপে ধাপে এক লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন তালহা। এর তিন মাস পর টাকা নিয়ে উধাও হয়ে যায় অ্যাপভিত্তিক ওই প্রতিষ্ঠান।

এ তো গেল দেশের খবর। পাশের দেশ ভারতেও একই অবস্থা। আহমেদাবাদের গান্ধীনগরের ঘটনা। সফটওয়্যার প্রকৌশলী কূলদীপ প্যাটেলের সঙ্গে জুনে ম্যাট্রিমোনিয়াল সাইটে পরিচয় হয় অদিতি নামের এক নারীর। অদিতি কূলদীপকে জানান, তাঁর যুক্তরাজ্যভিত্তিক আমদানি-রপ্তানির ব্যবসা আছে। তিনি কূলদীপকে ‘ব্যানোকয়েন’-এ বিনিয়োগ করতে বলেন। কথামতো কূলদীপ ওই ওয়েবসাইটে রেজিস্ট্রেশন করেন। প্রথমবার যখন ১ লাখ রুপি (১ লাখ ৩২ হাজার টাকা) বিনিয়োগ করেন, পরদিন ৭৮ ডলার (৮ হাজার ৫০০ টাকা) লাভ হয়েছে দেখায়। এরপর ২০ জুলাই থেকে ৩১ আগস্টের মধ্যে কূলদীপ ১৮ বার সেখানে ১ কোটির বেশি টাকা বিনিয়োগ করেন। এরপর কোনো একটা বিশেষ প্রয়োজনে কূলদীপ তিন লাখ টাকা তুলতে গিয়ে দেখেন, তাঁর অ্যাকাউন্ট ‘ফ্রোজেন’ হয়ে গেছে।

কূলদীপ প্যাটেল ব্যানোকয়েনের কাস্টমার কেয়ারে ফোন করেন। সেখান থেকে বলা হয়, ৩৫ লাখ টাকা দিলে তাঁর অ্যাকাউন্ট চালু করে দেওয়া হবে। এরপর প্যাটেল অদিতির সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে ‘স্বাভাবিকভাবেই’ ব্যর্থ হন। তখন প্যাটেল বুঝতে পারেন, তিনি প্রতারণার শিকার। ৯ সেপ্টেম্বর তিনি মামলা করেন।

কেন মানুষ বারবার অনলাইনে প্রতারণার ফাঁদে পা দেয়

১. মানুষ স্বাভাবিকভাবেই মানুষকে বিশ্বাস করে। অনেক সময় পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হওয়া বা ব্যক্তিগত সম্পর্কের হতাশা থেকেও মানুষ মরিয়া হয়ে অনলাইনে নতুন সম্পর্কে জড়াতে চায়। আর প্রতারকেরা নিজেদের ‘হাই প্রোফাইল’ হিসেবে পরিচিত করায়। ফলে সহজেই কেউ সেই ‘সম্পর্কের’ দিকে ধাবিত হয়।

২. আর্থিকভাবে লাভবান হতে কে না চায়। অল্প সময়ে অনেক টাকার লোভ অনেকেরই থাকে। সম্পর্ক আর অর্থ—দুটোর প্রতি মানুষের আদিম আকর্ষণ।

৩. প্রতারকেরা ধাপে ধাপে আস্থা অর্জন করে। এমনভাবে ফাঁদ সাজায় যে তাতে পা দিয়ে ফেলেন অনেকেই। ওয়েবসাইট, ট্র্যাকিং নম্বর, অনলাইন লোকেশন, হেল্পলাইন—এসব তৈরিই থাকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই মানুষ বিশ্বাস করে।

৪. অনলাইনের প্রতারকেরা দলগতভাবে, পরিকল্পনামাফিক কাজ করে। ফলে বোঝা খুব মুশকিল যে এটা ফাঁদ। অনেক সময় মানুষ প্রাথমিকভাবে লাভবান হন। এভাবে লাভবান হতে হতে যখন কেউ অনেক বড় অঙ্ক বিনিয়োগ করেন, তখনই প্রতারিত হন!

৫. আবার অনেক সময় দেখা যায়, আশপাশে শিক্ষাগত যোগ্যতায়, অর্থনৈতিকভাবে, সামাজিক মর্যাদায় এগিয়ে থাকা মানুষেরাও কোনো না কোনো প্রতারণার ফাঁদে পা দিয়েছেন। ফলে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা লোকজন একই প্রতারণার ফাঁদে পা দেন না বুঝেই।

কীভাবে বাঁচবেন এসব প্রতারণার ফাঁদ থেকে

১. এসব প্রতারণার ফাঁদ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখা সহজ নয়। কেননা, প্রতারকেরা অত্যন্ত ধুরন্ধর। আর তাঁদের ফাঁদ খুবই নিখুঁত। তাই অনলাইন দুনিয়ায় অপরিচিত কাউকে সহজে বিশ্বাস করবেন না। কেননা, সেখানে প্রতারণা করা খুবই সহজ।

২. আপনার ব্যক্তিগত তথ্য বা ছবি যদি কারও কাছে থেকেই থাকে, আর সেসব দিয়ে কেউ যদি আপনাকে ব্ল্যাকমেলের চেষ্টা করে, ঘাবড়ে না গিয়ে আইনের সাহায্য নিন।

৩. কারও সঙ্গে সম্পর্কে জড়ানোর আগে ভালোভাবে তাঁর সম্পর্কে খোঁজখবর নিন। তাঁর শহর, গ্রাম, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিস, সহকর্মী, পরিবার, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিন।

৪. নিজের কষ্টে উপার্জিত টাকা বিনিয়োগ করার আগে ভালোভাবে চিন্তা করুন, পরামর্শ নিন।

৫. অনলাইনে অজানা খাতে বিনিয়োগের আগে ভাবুন। ‘অফলাইনে’ টাকা বিনিয়োগ করার অসংখ্য নিরাপদ উপায় আছে। জমি, বাড়ি, গাড়ি, সোনা—এসব কিনুন। সময়ের সঙ্গে এসবের দাম বাড়বেই। নিরাপদ ব্যবসায় বিনিয়োগ করুন। টাকায় টাকা আনে, টাকা দিয়ে নিজের একটা বিকল্প আয়ের পথ খুলে ফেলুন।

৬. যদি ভাবেন, আপনি প্রতারণার শিকার হবেন না, তা একেবারে ভুল। একবার হয়েছেন বলে আর হবেন না, সেটাও ভুল। প্রতারকেরা সব সময় আপনাকে খুঁজছে। আর অনলাইন প্রতারণায় অভিনব ও নিখুঁত সব পদ্ধতি বের হচ্ছে।

৭. প্রতারকেরা সব সময় জরুরি অবস্থার সৃষ্টি করে এবং দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে বলে। লোভের বশবর্তী হয়ে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। টাকা বিনিয়োগ করার আগে সময় নিন।

Developer

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.