যে বাড়িতে পাখির কলকাকলি আর নির্মল বাতাসে ফুরিয়ে যায় সময়

বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামে দুই বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে পুনশ্চ

ঢাকার জিগাতলায় একটি ফ্ল্যাটে থাকেন অণিমা রায় ও তাঁর পরিবার। টপ ফ্লোরে এই ফ্ল্যাটের অবস্থান। ফ্ল্যাটের ছাদে অণিমা গড়ে তুলেছিলেন সুন্দর এক ছাদবাগান। নানা রকমের গাছ ছিল। আর ছিল দেশীয় নানা ফল। ২০১৭ সালে একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে বাড়ি ফিরে দেখেন, কে বা কারা তাঁর বড় বড় গাছের ড্রামগুলো ছাদ থেকে নিচে নামাচ্ছেন।

অন্দরসজ্জায় চোখের আরামকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে

দৌড়ে ছাদে গিয়ে দেখেন, এক এক করে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে তাঁর সব গাছ। বিষয়টি কোনোভাবেই মানতে পারছিলেন না এই শিল্পী ও শিক্ষক। অণিমা বলেন, ‘আসলে ওদের আচরণ এমন ছিল যে আমরা আর প্রতিবাদ করার সাহস পাইনি।’ তাঁর মনে হতে থাকে, ‘দূরে কোথাও যদি নিজের মতো একটা আবাস গড়ে তুলতে পারতাম, তাহলে আজকের এই দিন দেখতে হতো না।’ আসলে অণিমা গাছ খুব ভালোবাসেন। আর ছাদের গাছগুলোকে সন্তানস্নেহে বড় করেছিলেন।

একটু একটু করে অণিমা রায় গড়ে তুলেছেন তার স্বপ্নের বাড়ি

ওই সময়ে যে ভাবনাটা তাঁকে সবচেয়ে বেশি তাড়া করছিল, তা হলো ছাদের এত এত গাছ এখন কোথায় রাখব।

‘এই সময় ছড়াকার আমিরুল ইসলাম আমাদের বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামের কথা বলেন। খুব অল্প মূল্যে তখন সেখানে জমি বিক্রি হচ্ছিল। এই সময় কবি (আসলাম) সানী ভাই সেখানে আমাদের জায়গা কেনার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই জায়গা কিনে ঢাকা থেকে সব গাছ নিয়ে গেলাম। ড্রাম থেকে মাটিতে লাগানো হলো সব গাছ। একজন মালী রাখলাম। গাছগুলোর দেখাশোনা করতে প্রায়ই সেখানে যেতাম। তাই সেখানে গিয়ে বসার জন্য ছন দিয়ে একটা ছাপরা বানালাম। একসময় ভাবলাম, নিজেরা যাতে মাঝেমধ্যে এখানে এসে থাকতে পারি, সে জন্য তো একটা ঘর তুলে রাখা যায়। এভাবেই একটু একটু করে গড়ে তুললাম আমার স্বপ্নের বাড়ি। এখন তো সময় পেলেই সেখানে ছুটে যাই,’ বলছিলেন অণিমা।শুধু কণ্ঠে নয়, মননেও রবীন্দ্রনাথকে ধারণ করেন অণিমা রায়। কবির চিন্তাচেতনা, জীবনাচরণ—সবকিছু দ্বারাই ভীষণভাবে প্রভাবিত তিনি। দৈনন্দিন জীবনযাপনে তো আছেই, নিজের আবাসেও আছে রাবীন্দ্রিক ছোঁয়া। বাড়িটার নামও তিনি রেখেছেন ‘পুনশ্চ’। এই নামকরণের পেছনে একটা গল্পও অবশ্য আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষাসফরে একবার শান্তিনিকেতন গিয়েছিলেন অণিমা রায়। ঘুরতে ঘুরতে যখন রবীন্দ্রনাথের ‘পুনশ্চ’ বাড়িটির সামনে এসে দাঁড়ান, তখন শিক্ষার্থীদের কাছে জানান তাঁর মনের এক গোপন ইচ্ছার কথা—পুনশ্চ নামে নিজের একটা বাড়ি যদি থাকত। সৃষ্টিকর্তা এত তাড়াতাড়ি যে তাঁর ইচ্ছা পূরণ করবেন, ভাবতে পারেননি। ‘এখন সত্যিই আমার জীবনের কাছে কিছু চাওয়ার নেই,’ বলছিলেন অণিমা।

ঘর সাজাতে অণিমা রায়  ব্যবহার করেছেন সব দেশীয় উপকরণ

অণিমা রায় ও তার স্বামী সাংবাদিক তানভীর তারেক সব সময় চেয়েছিলেন, তাঁর সন্তান বেড়ে উঠবে এমন একটা পরিবেশে, যেখানে থাকবে প্রকৃতির ছোঁয়া। শহরে তো তেমনটা পাওয়া সম্ভব নয়। ‘পুনশ্চতে খোলা সবুজ মাঠে আমার ১০ বছরের ছেলে অমিয় ছুটে বেড়াচ্ছে, এই দৃশ্য যে কী আনন্দ দেয়, বলে বোঝাতে পারব না! কত রকম পাখির ডাক যে শুনতে পাই! মনে হয়, এ তো ঈশ্বরের বিশেষ আশীর্বাদ,’ বলছিলেন অণিমা।বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামে দুই বিঘা জমির ওপর গড়ে উঠেছে পুনশ্চ। এক হাজার বর্গফুটের ডুপ্লেক্স বাড়িটির সবকিছুই তিনি সাজিয়েছেন নিজের মতো করে। ব্যবহার করেছেন সব দেশীয় উপকরণ। অন্দরসজ্জার ক্ষেত্রে প্রাধান্য পেয়েছে চোখের আরাম।শান্তিনিকেতন খোয়াইয়ের মাটির রং লাল, অণিমা রায়েরও বিশেষ পছন্দ মাটির এই রং। খুব অবাক হয়েছিলেন, যখন দেখলেন বিরুলিয়ার গোলাপ গ্রামের মাটির রংও লাল।

সেই লাল মাটির আবহ রেখেছেন পুনশ্চর আঙিনায়। বাড়ির প্রধান ফটক পার হলেই গোল গোল সিমেন্টের ব্লক দিয়ে লাল মাটির চিকন পথ করা আছে। দুই পাশে নানা রকম গাছ পেরিয়ে সামনে এগোলেই লাল ইটের বাড়ি। যাতে লতাপাতার মায়ায় জড়িয়ে রয়েছে বাগানবিলাস। দেয়ালে পাথর আর টেরাকোটার নকশার মধ্যে লেখা বাড়ির নাম—পুনশ্চ।

বাড়ির এক পাশে ছোট্ট একটা সুইমিংপুল। আরেক দিক অনেকটা খোলামেলা। মূল বাড়ির বাইরে একটা একচালা ঘরও করেছেন, রেওয়াজ করার জন্য। বাড়ির নিচতলায় বসার জায়গা, ডাইনিং, রান্নাঘর আর আছে অতিথির ঘর। আঁকা ছবি দিয়ে সাজিয়েছেন দেয়াল।এক পাশের সিঁড়ি ধরে দোতলায় উঠে এলেই একাধিক শোবার ঘর। বারান্দার একদিকে দোলনা। খোলামেলা বাতাসে এখানে বসে থাকলে যে কারও মন জুড়িয়ে যাবে। একদিকের তাকে নানা রকম বই রাখা আছে। অণিমা রায় বলেন, ‘সময় পেলেই এখানে আসি। পাখির কলকাকলি আর নির্মল বাতাসে কখন যে সময় ফুরিয়ে যায়।’ 

Developer

Add comment

Follow us

Don't be shy, get in touch. We love meeting interesting people and making new friends.