ছোট্ট এক শহরতলি। সরকারি আবাসিক এলাকায় শিশুদের জন্য ছোটখাটো একটি পার্কের ব্যবস্থা। নানা অনুষঙ্গে সাজানো পার্কটিতে দোলনা ছিল চারটি। তাতে একঝাঁক শিশুর লাইন, তাই সাধ মিটিয়ে দোল খাওয়ার বাসনা পূরণ হতো না। কিন্তু শিশুদের ভীষণ পছন্দের জিনিস এই দোলনা। তাই যে একবার সুযোগ পায়, সে-ও কি তাড়াতাড়ি ছেড়ে দেয়? চার শিশু মিলে তাই বুদ্ধি করল একদিন। যে যার মতো গিয়ে দোলনায় নিজের নাম সেঁটে দেবে। যারা আগে আসবে, তারাই দোলনার দখল নেওয়ার সুযোগ পাবে। অন্য কেউ তাতে চড়ার সুযোগ পাবে কি না, সেটা নির্ভর করবে সেই চারজনের ইচ্ছার ওপর। আমার মনে পড়ে, ছোটবেলার সেই দিনের কথা। আগে যেতে পারিনি বলে সেদিন দোলনায় চড়া হয়নি। শেষমেশ কীভাবে সেই দখলদারি আইন বাতিল হয়েছিল, তা অবশ্য আজ আর মনে নেই।
শিশুরা খেলার মাঠে বা পার্কে যায় আনন্দের জন্য। তার মধ্যে যদি মন খারাপ কিংবা দখলদারত্বের অনুভূতি হানা দেয়, তা কিন্তু শিশুর জন্য নেতিবাচক একটি বিষয়। পরিবারের সবার নয়নমণি হয়ে বেড়ে উঠতে থাকা একটি শিশু সামাজিক পরিসরে মেশার সুযোগ পায় খেলার মাঠ থেকেই। তাই অন্যের সঙ্গে আচরণ কেমন হওয়া উচিত, তা এখান থেকেই শিখতে শুরু করে শিশু। তাই অভিভাবকের ভূমিকা এখানে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ। ছোট শিশুর সঙ্গে অভিভাবকেরাও যান খেলার জায়গায়। একটু বড় হলে তাদের একলা ছেড়ে দেওয়া হয়। তবে সব ক্ষেত্রেই শিশুর আচরণ যাতে সংযত এবং সুন্দর হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা অভিভাবকের কর্তব্য। এমনই কিছু বিষয় জেনে নেওয়া যাক আজ। বয়স এবং মানসিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে বিষয়গুলো বুঝিয়ে দিতে হবে শিশুকে।
খেলার সরঞ্জাম ভাগ করে নিক
দোলনার মতো আকর্ষণীয় সরঞ্জামে সব শিশুকেই সুযোগ দিতে হবে। এটি তো আর নিজের বাড়ির জিনিস নয়। এতে সবারই সমান অধিকার। শিশুকে বুঝিয়ে বলতে হবে, যাতে সে কিছুক্ষণ খেলার পর অবশ্যই বাকিদের সুযোগ দেয়। তাকে বোঝাতে হবে, এই যে সে নিজের আনন্দে ছাড় দিয়ে অন্যকে সুযোগ দিচ্ছে, এতে কিন্তু সে-ও অন্যের সেই আনন্দের ভাগীদার হচ্ছে। মিলেমিশে খেলার মধ্যেই তো খেলার আসল মজা। আবার নিজের বাড়িতে দোলনা, ক্রিকেট ব্যাট বা বিশেষ কোনো খেলনা থাকলেও অন্যদের সঙ্গে তা ভাগ করে নিতে শেখান শিশুকে। অন্যের সঙ্গে যেকোনো জিনিস ভাগ করে নেওয়ার এই শিক্ষা তার সারা জীবনের পাথেয় হবে। খেলার মাঠে সবারই ব্যাট বা ফুটবল থাকবে না। কিন্তু ‘আমার ব্যাট, তাই আমিই ব্যাটিং করব’, এমন মনোভাব যেন শিশু না রাখে। সবাই মিলে খেলার মধ্যেই তো আনন্দ।
দশে মিলে খেলাধুলা
খেলতে খেলতে মতের অমিল হতে পারে। প্রতিযোগিতামূলক খেলায় হার-জিত থাকে। তা নিয়ে তর্কাতর্কি হতে পারে। কিন্তু এসব নিয়ে অতিরিক্ত কিছু করতে দেখলে শিশুকে বুঝিয়ে বলুন। ঝগড়ার মনোভাব যাতে না গড়ে ওঠে, সেদিকে খেয়াল রাখুন। প্রত্যেকেই ভাবে, নিজেরটা ঠিক, অন্যেরটা ভুল। কিন্তু নিজের কথাটা ঠিক হলেও বন্ধুদের জন্য কিছু ছাড় যে দিতে হয়, তা শিখিয়ে দিন শিশুকে।
- নানা পরিবারের শিশুরা আসে খেলার জায়গায়। সবাই এক রকম হবে না, এটাই স্বাভাবিক। কেউ জোরে ছুটতে পারবে, কেউ পারবে না। কারও কথায় আঞ্চলিকতার টান থাকবে—এগুলো স্বাভাবিক বিষয়। কারও মধ্যে ভিন্ন রকম কিছু লক্ষ করলে তা নিয়ে হাসাহাসি করা, কানাকানি করা কিংবা নেতিবাচক মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দিন শিশুকে।
- কোনো কিছু নিয়ে অহংকার করা যাবে না। অন্যের ভালো দেখে হিংসা করা যাবে না।
- অন্যের খেলনা স্পর্শ করার আগে তার অনুমতি নেওয়ার শিক্ষাও দিন শিশুকে।
কারও ক্ষতি না হোক
- স্লিপারের পিচ্ছিল অংশ বেয়ে ওপরে ওঠার চেষ্টা করা যাবে না। এতে শিশু ব্যথা পেতে পারে। অন্য শিশু ওপর থেকে নেমে এলে দুজনেই আহত হতে পারে।
- দৌড়ঝাঁপ করতে গিয়ে অন্য কেউ ব্যথা পাচ্ছে কি না, সেদিকে খেয়াল রাখুন। উত্তেজিতভাবে দৌড় দিতে গিয়ে শিশু তার চেয়ে ছোট কাউকে কিংবা কোনো প্রাণীকে খেয়ালই করল না, এমনটা যাতে না হয়।
- মারামারি থেকে বিরত থাকতে হবে অবশ্যই।
- শিশুরা অনেক সময় খালি দোলনায় দোল দেয়। এই দোলনায় অন্য কারও আঘাত লাগছে কি না, তা খেয়াল রাখতে বলে দিন শিশুকে।
- দৌড়ঝাঁপ করতে করতে হুট করে গিয়ে একেবারে ছোট শিশু (যেমন: কারও কোলে বা স্ট্রলারে চড়ে বেড়াতে আসা শিশু) বা তার খেলনা স্পর্শ করা উচিত নয়। এটিও বলে রাখুন শিশুকে। তার হাতে লেগে থাকা ময়লায় ছোট শিশুর ক্ষতি হতে পারে।
- আশপাশে পশুপাখি থাকতে পারে। তাদের ধাওয়া করা যাবে না, তাড়ানোর চেষ্টা করা যাবে না। হুসহাস শব্দে তাদের বিরক্ত করা যাবে না। পাখির ডিম, পশুপাখির বাচ্চা, ফড়িং, প্রজাপতি, গাছের ডাল প্রভৃতি ধরা কোনো খেলা নয়। এগুলোর ক্ষতি করা যাবে না, শিশুকে সেটা শিখিয়ে দিন।
Add comment